Header Ads Widget

বি বি নিউজ
বাংলা খবর সবার আগে

চেঙ্গিস খানের অমীমাংসিত মৃত্যুরহস্য

unsolved mystery of genghis khan

BB NEWS DESK-


কারো কাছে চেঙ্গিস খান ছিলেন বিখ্যাত এক বিজেতা, কারো কাছে আবার মানবজাতির জন্য অভিশাপ, রক্তলোলুপ এক শাসক। শৈশবেই উপজাতীয় সর্দার বাবাকে হারানোর পর তার স্থলাভিষিক্ত হন তেমুজিন (চেঙ্গিস খানের পূর্ব নাম)। কিন্তু এত অল্প বয়সী একটি ছেলেকে নেতা হিসেবে মেনে নিতে চায় নি গোত্রের অন্যান্যরা।


দিন পার হতে থাকে, বাড়তে থাকে বালক তেমুজিনের বয়স। কৈশোরের শেষের দিকে তার শারীরিক গঠন, শৌর্যবীর্যের কাহিনী ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে চারদিকে, ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তার অনুসারীর সংখ্যা। একবার বিরোধী এক গোত্র অপহরণ করে নিয়ে যায় যুবক তেমুজিনের স্ত্রীকে। ক্ষিপ্ত তেমুজিন লড়াই করেই ছিনিয়ে আনেন স্বীয় অর্ধাঙ্গিনীকে।




এরপর আস্তে আস্তে যেন খোলস ছেড়ে বেরোতে শুরু করেন তেমুজিন। তার স্বপ্ন ছিলো আকাশ ছোঁয়ার। সেই শীর্ষস্থানে পৌঁছানোর জন্য রাস্তা তৈরিতে এবার মনোযোগ দেন তিনি। বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত মঙ্গোল জাতিকে একত্রিত করে একটি সম্মিলিত শক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে চান তিনি। অনেক গোত্রই স্বেচ্ছায় তার বশ্যতা মেনে নেয়। যারা মানে নি, তাদের সাথে যুদ্ধ করে বশ্যতা মানানো হয়। পরাজিত গোত্রগুলোর সামনে ছিলো দুটো রাস্তা- হয় চেঙ্গিস খানের নেতৃত্ব মেনে নিতে হবে, নয়তো চিরতরে ছেড়ে যেতে হবে এ পৃথিবী।


১২০৬ সালে অবশেষে সুবিশাল মঙ্গোল সাম্রাজ্যের অধিপতি হিসেবে সবাই মেনে নেয় তেমুজিনকে। তার উপাধি হয় ‘চেঙ্গিস খান’, যার অর্থ ‘বিশ্বজনীন শাসক’। আজ আমরা যত না তার আসল নাম ‘তেমুজিন’ জানি, তার চেয়েও বেশি জানি তার উপাধিটাকে।



এরপর একে একে শুরু হয় মঙ্গোল বাহিনীর বিজয়াভিযান। ইউরেশিয়ার অধিকাংশ এলাকা চলে আসে মঙ্গোল বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। তার জীবদ্দশায় ক্বারা খিতাই, ককেশাস, খারেজমিয়ান, পশ্চিম জিয়া ও জিন রাজবংশের বিরুদ্ধে লড়েছিলো মঙ্গোল বাহিনী। এসব অভিযানে বিপুল সংখ্যক সাধারণ জনগণ প্রাণ হারায়। তার মৃত্যুর সময় মধ্য এশিয়া ও চীনের বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিলো মঙ্গোল সাম্রাজ্য।


১২২৭ সালের ১৮ আগস্ট দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেন চেঙ্গিস খান। কিন্তু তবুও যেন বিদায় নিলেন না এই খান! কিভাবে? তার মৃত্যু যে ঠিক কিভাবে হয়েছিলো তা নিয়ে বিতর্কের কোনো অন্ত নেই। শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে চেঙ্গিসের মৃত্যুর যে বর্ণনা শুনতে পাওয়া যেত, তার সাথে কোনো মিল ছিলো না শত্রুপক্ষের দেয়া বর্ণনার। দুই পক্ষের বর্ণনা থেকে অন্তত এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, একপক্ষ চেয়েছিলো তার মৃত্যুকে মহিমান্বিত করে তুলতে, যেখানে অন্য পক্ষ চেয়েছিলো একই বিষয়কে কলঙ্কিত করে উপস্থাপন করতে। তাই ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়া, নিউমোনিয়া, যুদ্ধে মৃত্যুর কথা যেমন শোনা যায়, তেমনি তাঙ্গুত গোষ্ঠীর রাজকন্যার সম্ভ্রমহানি করতে গেলে সেই নারী তার জননাঙ্গ কেটে দেয়ায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যুর কথাও শোনা যায়।



এগুলোর মাঝে কোনটি যে একশভাগ সত্য তা নির্ণয়ের আজ আর কোনো উপায় নেই। মৃত্যুর নিয়ে ধোঁয়াশার পাশাপাশি আজও অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে চেঙ্গিস খানের কবরটি। শত শত বছর ধরে অনেক গবেষক তাদের জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন শুধুমাত্র রক্তলোলুপ এই শাসকের শেষ নিদ্রাস্থলটি খুঁজে বের করতে। কিন্তু ব্যর্থ হতে হয়েছে তাদের সবাইকেই। আমাদের আজকের এ লেখায় তাই চেঙ্গিস খানের মৃত্যু এবং কবরকে খোঁজা নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।


মৃত্যু

প্রথমে চলুন চেঙ্গিস খানের মৃত্যু নিয়ে যত তত্ত্ব প্রচলিত আছে সেগুলো সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।


খোজাকরণের ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু

চীনে একটি বিদ্রোহ দমন করতে ১২২৬ সালে পারস্য থেকে চীনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন চেঙ্গিস খান। জিয়া ও জিন রাজবংশকে এক দশক আগেই তিনি পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু খানের অনুপস্থিতির সুযোগে স্বাধীনতার নেশা তাদের মাঝে আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিলো। মঙ্গোল বাহিনী তাদের শক্ত হাতে দমন করতে সক্ষম হয়। ১২২৭ সালে জিয়া রাজবংশের অধিকাংশ (তাঙ্গুত বংশধারা) সদস্যকেই হত্যা করতে সক্ষম হয় মঙ্গোল বাহিনী। পরবর্তীতে যাতে আর কোনো বিদ্রোহী মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সেজন্যই বেছে নেয়া হয়েছিলো নির্মম এ হত্যাকান্ডের পথটি।



এখন যে কাহিনীটি বলতে যাচ্ছি সেটি মঙ্গোলীয় গোত্রগুলোর মুখে ঘুরে বেড়ায়। এক রাতে চেঙ্গিস খান স্বপ্নে দেখলেন যে, শুভ্র তুষারের উপর পড়ে আছে কারো তাজা লাল রক্ত। এমন স্বপ্ন দেখে স্বাভাবিকভাবেই তিনি খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। পরদিন আবার তাঙ্গুতদের সর্বশেষ বিদ্রোহী যুবরাজের সাথে যুদ্ধ ছিলো মঙ্গোলদের। দ্য গ্রেট খান তাই আর দেরি না করে চলে গেলেন পুরোহিতদের কাছে, জানতে চাইলেন স্বপ্নের ব্যাখ্যা। উত্তরে তারা জানালেন যে, রক্তের ধারাটি সেই তাঙ্গুত যুবরাজের যে কিনা যুদ্ধে নিহত হবে। আর শুভ্র তুষার দিয়ে বোঝানো হয়েছে যুবরাজের অপরুপা কন্যাকে যে কিনা তার কাছে বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসা সবাইকেই ফিরিয়ে দিয়েছে।


পরদিন যুদ্ধে সেই তাঙ্গুত যুবরাজকে হত্যা করে তার সুন্দরী মেয়েটিকে নিজের শয়নকক্ষে নিয়ে যান চেঙ্গিস খান। যখন তিনি মেয়েটির সম্ভ্রমহানীর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন, তখনই মেয়েটি মারাত্মক সাহসের পরিচয় দিয়ে বসে। খোঁপার আড়ালে লুকনো ছোট্ট একটি ছোরা বের করে খানের জননাঙ্গ কেটে দেয় সে! এরপর আর মেয়েটি সেখানে অপেক্ষা করে নি। শারীরিক লাঞ্ছনার হাত থেকে বাঁচতে দ্রুত পালিয়ে যায় সে, ঝাঁপ দেয় পাশেই থাকা হলুদ নদীতে। এরপর থেকেই তার সম্মানার্থে নদীটির নাম দেয়া হয় ‘রাজকন্যার নদী (খাতুন গল)’।


এখন প্রশ্ন হলো- এ কাহিনী আসলে কতটা সত্য? এমন একটি ঘটনা চেঙ্গিস খানের জীবনের শেষ মুহূর্তকে স্বাভাবিকভাবেই কলঙ্কিত করে তোলে। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, চেঙ্গিস খানের মৃত্যুকে নোংরাভাবে দেখানো এ কাহিনীর প্রবক্তা ঐরাত গোত্র। ‘পশ্চিমা মঙ্গোল’ নামে পরিচিত ঐরাতরা আজীবনই চেঙ্গিসের ‘পূর্ব মঙ্গোল’দের শত্রু ছিলো। খোজাকরণের মাধ্যমে চেঙ্গিসের মৃত্যুর এ কাহিনীটির উদ্ভব ঘটে সতের শতকে। তখনকার সময়ে মঙ্গোল গোত্রগুলোর মাঝে দাঙ্গা চলছিলো। ফলে অধিকাংশ ইতিহাসবিদই কাহিনীটিকে মিথ্যে বলে সাব্যস্ত করেছেন।


যুদ্ধরত অবস্থায় মৃত্যু

হাইপেশিয়ান কোডেক্স অনুসারে ১২২৭ সালে চীনাদের বিরুদ্ধে জীবনের সর্বশেষ যুদ্ধেই নিহত হয়েছিলেন চেঙ্গিস খান। ১৪২৫ সালে লিখিত এ কোডেক্সটি বর্তমানে সেন্ট পিটার্সবার্গে রাশিয়ান ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে রাখা আছে।

মার্কো পোলোর বর্ণনানুযায়ী, কাজু নামক এক দুর্গের পতন ঘটানোর উদ্দেশ্যে যুদ্ধরত অবস্থায় হাঁটুতে তীর বিদ্ধ হন চেঙ্গিস। পরবর্তীতে এ আঘাতেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।


ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যু

‘Secret History of the Mongols’ নামক মঙ্গোল সাম্রাজ্যের ঘটনাপঞ্জীতে উল্লেখ করা আছে যে, ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েই মৃত্যু হয়েছিলো চেঙ্গিস খানের।

বইটির বর্ণনানুযায়ী চেঙ্গিস তার লোকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঙ্গুতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রার প্রস্তুতি নিতে। তিনি সেই সময় দক্ষিণ মঙ্গোলিয়ায় শীত আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন এবং বন্য ঘোড়া শিকার করে সময় পার করছিলেন। একদিন দুর্ঘটনাবশত শিকাররত অবস্থায় ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে বেশ আহত হন ৬৫ বছর বয়সী চেঙ্গিস খান।



একদিকে শীত সহ্য করতে না পেরে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া, অন্যদিকে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মারাত্মক আহত হওয়া- দুটোই মারাত্মক কাবু করে ফেলেছিলো মঙ্গোল অধিপতিকে। এই অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি যুদ্ধ পরিচালনার নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। অবশেষে যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই অসুস্থতার কারণে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন চেঙ্গিস খান।


এখন প্রশ্ন হলো- এই বর্ণনাই বা কতটুকু সঠিক? ‘Secret History of the Mongols’ লেখা হয়েছিলো ১২৪০ সালে। বলা হয়ে থাকে যে, চেঙ্গিসের এক পালক পুত্রের বর্ণনার উপর ভিত্তি করেই বইটি লেখা। এজন্য উপরোক্ত তিনটি সম্ভাব্যতার মাঝে এটিই সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।


মৃত্যুর পরও যখন মৃত্যুর কারণ চেঙ্গিস খান

নিজের মৃত্যুশয্যায় চেঙ্গিস খান ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যে, জি জিয়া রাজ্যটিকে যেন পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে দেয়া হয়। তার নির্দেশটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলো অনুগত বংশধরেরা। শহরটিকে একেবারে ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলো তারা। নির্বিচারে গণহত্যা চালানো হয় নিরপরাধ জনগণের উপর, ক্রীতদাস হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয় আরো অনেককেই।


চেঙ্গিস খান চেয়েছিলেন তার কবরটি যেন কেউ কোনোদিন খুঁজে না পায়। তার সেই নির্দেশটিও ঠিকমতোই পালন করেছিলো মঙ্গোল বাহিনী। তার মৃতদেহবাহী সেই দলটির চীন থেকে মঙ্গোলিয়া আসতে সপ্তাহখানেক সময় লেগেছিলো। কথিত আছে যে, দীর্ঘ এ যাত্রাপথে যে ব্যক্তিই দলটির সামনে পড়েছিলো, তাকেই হত্যা করেছিলো মঙ্গোল সেনারা। সমাধিস্তম্ভটি বানানো শেষ হলে যারা সেটি বানিয়েছিলো, তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়। এরপর সেখানে থাকা সৈন্যরাও আত্মহত্যা করে!




চেঙ্গিস খানের কবরটির সঠিক অবস্থান গোপন করার জন্য তার আজ্ঞাধীন সৈন্যরা যে অনেক চেষ্টা করেছিলো সেই ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু সেই চেষ্টার মাত্রা ঠিক কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিলো, সেই সম্পর্কে কোনো সঠিক বর্ণনা দেয়ারও উপায় নেই। এজন্যই বিষয়টি নিয়ে গড়ে উঠেছে নানা কিংবদন্তী।


কথিত আছে, কবরটি লুকিয়ে ফেলার জন্য নাকি একটি নদীর গতিপথই পাল্টে দিয়েছিলো মঙ্গোল বাহিনী। তারা নদীটিকে কবরের উপর দিয়ে প্রবাহিত করেছিলো যাতে কেউ তা খুঁজে না পায়। এক বর্ণনায় আছে, কবরটির উপর দিয়ে চালনা করা হয়েছিলো অসংখ্য ঘোড়া। এরপর সেখানে লাগিয়ে দেয়া হয় একটি গাছ। পাশাপাশি তুষারপাতের ফলে একসময় কবরটি চলে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। আরেকটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, খানের মৃত্যুর ৩০ বছর পর কবরটি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো। চেঙ্গিস খানের সাথে একটি বাচ্চা উটকেও কবর দেয়া হয়েছিলো। পরবর্তীতে বাচ্চাটির মাকে সেই জায়গায় গিয়ে কাঁদতে দেখা গিয়েছিলো।


চেঙ্গিস খান বলেছিলেন কবরে যেন তার ছয়টি বিড়ালকেও সাথে দিয়ে দেয়া হয়, যাতে বিড়ালগুলোর ডাক শুনেই পরকালে তিনি মঙ্গোলিয়ায় পৌঁছাতে পারেন। মৃত্যুর পর তার সাথে ৪০ জন ‘চাঁদের মতো সুন্দরী’ কুমারী নারীকেও খুন করে কবর দেয়া হয়েছিলো তার সাথে, যেন পরজীবনে তারা তাকে সঙ্গ দিতে পারে! অবশ্য এ দাবির সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের উপায় নেই আজ। খানের মৃত্যুর প্রায় ৬০ বছর পর মঙ্গোলিয়া ভ্রমণে গিয়েছিলেন মার্কো পোলো। তিনিই এই কাহিনীটি জানিয়েছিলেন। বিড়াল ও কুমারীর পাশাপাশি অজস্র ধনরত্নও দিয়ে দেয়া হয়েছিলো চেঙ্গিসের কবরে।


 চেঙ্গিস খানের খোঁজে ইতিহাসবিদেরা

চেঙ্গিস খানের চিরনিদ্রায় শায়িত হবার স্থানটি বিশ্বের মানচিত্র থেকে চিরতরে মুছে দেয়ার প্রয়াস সম্পর্কে জানার পরও নিরুৎসাহিত হন নি ইতিহাসবিদেরা। বরং এ ঘটনাটি তাদের আগ্রহকে বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুণ। তাই চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর আটশ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও তার দেহাবশেষ খুঁজে বেড়াচ্ছেন গবেষকেরা।


অনেকে মনে করেন, মৃত্যুর পর চেঙ্গিস খানের দেহটি নিয়ে আসা হয়েছিলো তার জন্মস্থান খেন্তি প্রদেশে। সেখানে অনোন নদীর কাছাকাছি জায়গাতেই তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করার ব্যবস্থা করা হয়। আবার তাকে মঙ্গোলিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বুর্খান খালদুন পর্বতের কোনো এক জায়গায় কবর দেয়া হয়েছে বলেও মনে করেন কেউ কেউ।


অনোন নদী

শৌখিন প্রত্নতত্ত্ববিদ মাউরি ক্রাভিতজ তার জীবনের চল্লিশটি বছর ব্যয় করেছিলেন চেঙ্গিসের কবর খোঁজার কাজে। পনের শতকের এক তথ্যসূত্রের উপর নির্ভর করে তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে, ব্রুচি নদীর কাছাকাছি কোথাও থাকবে চেঙ্গিস খানের কবর। কিন্তু তৎকালীন মানচিত্রকারদের কেউই জায়গাটির সন্ধান দিতে পারেন নি। ২০১২ সালে মঙ্গোল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতার দেহাবশেষ খুঁজে না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়েই পরলোকে পাড়ি জমান ক্রাভিতজ।


চেঙ্গিস খানের সমাধিস্থল খুঁজে বের করতে বর্তমানে যারা রাত-দিন খেটে যাচ্ছেন, তাদের মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলেন ড. অ্যালবার্ট ইয়ু-মিন লিন। সরাসরি মঙ্গোলিয়ার বিভিন্ন জায়গার ক্ষতি করতে পারে এমন অভিযান না চালানোর জন্য তারা চালু করেছেন ‘The Valley of the Khan’ প্রজেক্ট।


স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত আল্ট্রা-হাই রেজ্যুলুশন ইমেজের সহায়তায় চেঙ্গিস খানের কবর খোঁজার কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে ড. লিনের দল। তবে সুবিশাল মঙ্গোল সাম্রাজ্যে দ্য গ্রেট খানের কবর খোঁজার ব্যাপারটা অনেকটা খড়ের গাঁদায় সুঁই খোঁজার মতোই। কঠিনতম ব্যাপার হলো, কেউই জানে না সুঁইটি কোথায়। তাই তন্ন তন্ন করে সবদিকই খোঁজা লাগছে, যা একইসাথে বেশ পরিশ্রমের এবং সময় নিয়ে নেয়া একটি কাজ।


ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের সাথে মিলিত হয়ে লিনের দল প্রায় ৮৪,০০০ টাইলের সমন্বয়ে ৬,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত একটি ল্যান্ডস্কেপ তৈরি করেছে। ২০১০ সালে চালু হওয়া এ সিস্টেমটির নাম দেয়া হয়েছে ‘ভার্চুয়াল এক্সপ্লোরেশন সিস্টেম’। এখানে অংশগ্রহণকারীদের কাজ হবে ছবি দেখে যদি মনে হয় এই জায়গাটিতে চেঙ্গিস খানের কবর থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, তবে সেই জায়গাটিকে ট্যাগ করা।


এককালের বিশ্বত্রাস মঙ্গোল সাম্রাজ্যের এ অধিপতিকে খুঁজে বের করতে প্রজেক্টটিতে যোগ দিয়েছিলো প্রায় ১০,০০০ মানুষ। তিন বছর ধরে ৩০,০০০ ঘন্টারও অধিক সময় ব্যয় করে তারা বিশ লাখেরও অধিক জায়গা ট্যাগ করেছিলো। অর্থাৎ সেই জায়গাগুলোকে তারা চেঙ্গিস খানের সম্ভাব্য কবর বলে চিহ্নিত করেছিলো। সেখান থেকে অনেক বাছাবাছি করে গবেষকেরা প্রথমে ১০০টি স্থান চিহ্নিত করেন। এরপরও আরো যাচাইবাছাই করে এ সংখ্যাটি নামিয়ে আনা হয় ৫৫-তে। বর্তমানে কাজ চলছে এই ৫৫টি জায়গা নিয়েই।




এককালের বিশ্বত্রাস মঙ্গোলাধিপতি চেঙ্গিস খানের নৃশংসতা জীবদ্দশায় যেমন মানুষকে বিস্মিত করেছে, মৃত্যুর পরও তেমনি তার মৃত্যু নিয়ে নানা কাহিনী ও প্রায় আটশ বছর ধরে অনাবিষ্কৃত কবর মানুষকে হতবিহবল করে ছেড়েছে। আসলেই কি কোনোদিন ইতিহাস বিখ্যাত এই খানের কবরের সন্ধান পাওয়া যাবে? নাকি এভাবেই কেটে যাবে আরো শতাব্দীর পর শতাব্দী? এ প্রশ্নের উত্তর নাহয় সময়ের কাছেই তোলা থাকুক। আর আমরা গালে হাত দিয়ে বসে ভাবতে থাকি, “কিভাবে পারলো লোকটা এমন ধূম্রজাল তৈরি করতে?”

তথ্যসূত্র

১) en.wikipedia.org/wiki/Tomb_of_Genghis_Khan

২) washingtonpost.com/news/morning-mix/wp/2015/01/08/the-frustrating-hunt-for-genghis-kahns-long-lost-tomb-just-got-a-whole-lot-easier/

৩) factsanddetails.com/asian/cat65/sub423/entry-5249.html

৪) owlcation.com/humanities/The-Death-of-Genghis-Khan

৫) en.wikipedia.org/wiki/Genghis_Khan

৬) history.com/this-day-in-history/genghis-khan-dies

৭) history.com/news/ask-history/where-is-genghis-khan-buried


 আরও পড়ুন- বাদশাহ বাবরের কাবুলের  সেই দিনগুলো

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ