Header Ads Widget

বি বি নিউজ
বাংলা খবর সবার আগে

বাইজেন্টাইন আমলের অসাধারণ এক স্থাপত্যকর্ম: হাজিয়া সোফিয়া

hagia sophia

BB NEWS DESK-

এশিয়া ও ইউরোপ এই দুটি মহাদেশের মাঝে তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরটি দাঁড়িয়ে আছে। এখানে বসবাসকারী  বসফরাস প্রণালী শহরটিকে দুভাগে ভাগ করে ফেলেছে। এই শহরেরই ইউরোপীয় অংশে রয়েছে এক স্থাপত্যবিস্ময়। বাইজেন্টাইন শাসনামলে বানানো এই স্থাপত্যকর্মটির নাম ‘হাজিয়া সোফিয়া’। 

বলা হয়, অনন্য সৌন্দর্য আর বৈশিষ্ট্যের বাইজেন্টাইন স্থাপত্যবিস্ময় হাজিয়া সোফিয়া স্থাপত্যকলার ইতিহাসকেই বদলে দিয়েছে। সে ইতিহাসে যোগ করেছে এক অন্য মাত্রা। এই স্থাপত্যটি সম্পর্ক এই লেখকের আগ্রহ সৃষ্টি হয় আমেরিকান ঔপন্যাসিক ড্যান ব্রাউনের ‘ইনফার্নো’ বইটি পড়তে গিয়ে। তাই সেই বই এবং বইয়ের লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েই শুরু করছি হাজিয়া সোফিয়া সম্পর্কে নানা জানা-অজানার বর্ণনা।


হাজিয়া সোফিয়া

বসফরাস প্রণালীর তীর ঘেঁষেই নির্মিত হয়েছে হাজিয়া সোফিয়া; Image Source: educaplay.com


হাজিয়া সোফিয়া নির্মাণ করা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১,৫০০ বছর আগে একটি বাইজেন্টাইন খ্রিস্টান ব্যাসিলিকা হিসেবে। কিন্তু বর্তমানে অনেকটা প্যারিসের আইফেল টাওয়ার বা এথেন্সের পার্থেননের মতো এটিও একটি অসাম্প্রদায়িক স্থাপত্যশৈলী হিসেবে পরিগণিত হয়। 


তুরস্কের পুরাতন অংশে বসফরাস প্রণালীর কোল ঘেঁষে নির্মিত এই স্থাপনাটি সনাতন খ্রিস্টান এবং মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষের কাছেই মর্যাদার বস্তু। কেননা, তুরস্কের বহু বছরের ঐতিহ্য আর ইতিহাসের ধারক-বাহক এই স্থাপনা। ইতিহাসের পালাবদলের সাথে সাথে বিভিন্ন সময় বদল হয়েছে এর পরিচয় এবং ব্যবহার। এটি বানানো হয়েছিল বাইজেন্টাইন খ্রিস্টানদের উপাসনালয় হিসেবে। 


সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে এটি ব্যবহৃত হয়েছে গ্রিক সনাতন খ্রিস্টানদের ক্যাথেড্রাল, রোমান ক্যাথলিকদের ক্যাথেড্রাল এবং মুসলিমদের মসজিদ হিসেবে। তবে, এটি বর্তমানে সব ধর্মের মানুষদের জন্য জাদুঘর হিসেবে উন্মুক্ত রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে হাজিয়া সোফিয়া খ্রিস্টান এবং মুসলিমদের প্রার্থনালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বলে এ স্থাপনাটিতে খ্রিস্টান এবং মুসলিমদের ধর্মের নানা অনুসঙ্গের সহাবস্থান চোখে পড়ে। এ দুটি ভিন্ন ধর্মের মানুষদের ধ্যান-ধ্যারণা আর চিন্তা-ভাবনা এসে যেন এক হয়ে মিলে গেছে হাজিয়া সোফিয়াতে।


হাজিয়া সোফিয়া নির্মাণের ইতিহাস

হাজিয়া সোফিয়ার তুর্কি নাম ‘আয়াসোফিয়া’। একে ‘পবিত্র জ্ঞানের চার্চ’ বা ‘স্বর্গীয় জ্ঞানের চার্চ’ নামেও ডাকা হয়। সর্বপ্রথম ৩৬০ খ্রিস্টাব্দে বাইজেন্টাইন সম্রাট কন্সটান্টিয়াস, বাইজেন্টাইন ব্যাসিলিকা হিসেবে হাজিয়া সোফিয়া নির্মাণের নির্দেশ দেন। সেসময় ইস্তাম্বুল শহরটির নাম ছিল কন্সটান্টিনোপল। সম্রাট কন্সটান্টিয়াসের বাবা, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট, প্রথম কন্সট্যান্টাইনের নামানুসারেই শহরটির নামকরণ করা হয়েছিল।


হাজিয়া সোফিয়ার ছাদ যখন প্রথম তৈরি হয়েছিলো সেটি ছিল কাঠের তৈরি। রাজপরিবারে সেই সময় রাজনৈতিক কলহের জেরে ৪০৪ খ্রিস্টাব্দে সে ছাদ আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছিল। এরপর ৪১৫ সালে সম্রাট থিওডোসিওস হাজিয়া সোফিয়া নতুন করে নির্মাণ করেন। 


দ্বিতীয়বার পুড়ে ছাই হওয়া হাজিয়া সোফিয়াও মেরামতের অযোগ্য ছিল। তাই সম্রাট জাস্টিনিয়ান ৫৩২ সালে নতুনভাবে এ গির্জা নির্মাণের আদেশ দেন সেসময়ের দুই বিখ্যাত স্থপতি ইসিডোরোস এবং অ্যান্থিমিয়োসকে। এই তৃতীয়বার নির্মিত অনন্য সাধারণ হাজিয়া সোফিয়ার নির্মাণ শেষ হয় ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে, যা আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্বগৌরবে।

হাজিয়া সোফিয়ার নকশা

যখন থেকে হাজিয়া সোফিয়ার তৃতীয় এবং শেষ সংস্করণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত হয়, তখন থেকে আজ অবধি এই স্থাপত্যশৈলী জনমনে বিস্ময়ের যোগান দিয়ে যাচ্ছে। সনাতন খ্রিস্টীয় চার্চের চিরাচরিত গঠন বৈশিষ্ট্যের সাথে মিল রেখে, অসাধারণ এক স্থাপত্যের জন্ম দিয়েছেন বাইজেন্টাইন স্থপতিরা। 


hagia sophia

হাজিয়া সোফিয়ার অভ্যন্তরভাগ; Image Source: medievalists.net

হাজিয়া সোফিয়াতে প্রবেশ করার সাথে সাথেই দর্শনার্থীরা এর বিশালতা আর নান্দনিকতায় মুগ্ধ হয়ে যেতে বাধ্য। হাজিয়া সোফিয়ার প্রধান কক্ষটি এতটাই বিশাল যে, ইউরোপের বড় বড় ক্যাথেড্রালগুলোকেও এর কাছে বামন মনে হয়। অবশ্য যতটা বিশাল মনে হয় এ ঘরটাকে ততটা বিশাল নয় এটি। বাইজেন্টাইন ফ্লোর পরিকল্পনার নকশাই এমন যে, তা দর্শনার্থীদের চোখে একধরনের বিভ্রম সৃষ্টি করে।


হাজিয়া সোফিয়ার ছাদের বিশাল সোনালী গম্বুজটি মেঝে থেকে কমপক্ষে একশত পঞ্চাশ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। সামনে থেকে দেখতে সেটি আরও অনেক বেশি উঁচু মনে হয়। সোনালী রঙের কারণে ছাদের এই বিশাল গম্বুজটিকে প্রায়শই ‘স্বর্ণের গম্বুজ’ বলা হয়ে থাকে। এই গম্বুজের কেন্দ্রবিন্দু থেকে চল্লিশটি রিব চতুর্দিকে এমনভাবে ছড়িয়ে রয়েছে, যেন সূর্য রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে সূর্যের চারিদিকে। 


গম্বুজ থেকে ছড়িয়ে পড়া চল্লিশটি রিব শেষ হয়েছে চল্লিশটি খিলানযুক্ত জানালাতে গিয়ে। দিনের বেলায় এসব জানালা দিয়ে আলো প্রবেশ করলে ভেতরে থাকা কাচ আর স্বর্ণের টাইলগুলো এমন একটি দ্যুতি ছড়ায় যাতে বিস্ময়াভিভূত হয়ে যায় দর্শনার্থীরা। এই দ্যুতি হাজিয়া সোফিয়ার ‘আধ্যাত্মিক আলো’ বলে পরিচিত। এছাড়াও গম্বুজের ছাদ থেকে তারের সাহায্যে হাজিয়া সোফিয়ার অভ্যন্তরে ঝুলে আছে চোখ ধাঁধানো কতকগুলো ঝাড়বাতি। সেগুলোর আলোয় ঝলমল করে উঠে এই স্থাপত্যের ভেতরটা।


এই যে বিশাল আকৃতিতে হাজিয়া সোফিয়া নির্মাণ করা হয়েছে, এর পেছনে দুটি উদ্দেশ্য রয়েছে বলে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। প্রথম উদ্দেশ্য, সৃষ্টিকর্তার কাছে মানুষের প্রার্থনার বিশালতা তুলে ধরা। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, প্রার্থনাকারীদের বিস্ময়াভিভূত করা, যাতে তারা এখানে ঢোকার পরে নিজের ক্ষুদ্রতাকে উপলব্ধি করতে পারে। সমস্ত অহংবোধ জলাঞ্জলী দিয়ে সৃষ্টিকর্তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে।

গির্জা থেকে মসজিদে রুপান্তর

বাইজেন্টাইনরা গ্রিকদের সনাতন ধর্ম অনুসরণ করত, আর হাজিয়া সোফিয়া ছিল তাদের প্রধান প্রার্থনালয়। এখানেই বাইজেন্টাইন সম্রাটরা শপথ নিতেন, প্রথম মুকুট পরতেন। হাজিয়া সোফিয়ার বর্গাকার মার্বেলের মেঝের যে অংশে রঙিন প্যাঁচানো নকশাঁ রয়েছে, গির্জার সেই মূল অংশে দাঁড়িয়েই মাথায় মুকুট পরতেন নতুন সম্রাটরা। ৯০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের এই ঐতিহ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে হাজিয়া সোফিয়া।


hagia sophia

Image Source: Newsweek

ত্রয়োদশ শতকে মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে সংগঠিত ক্রুসেডে হাজিয়া সোফিয়া কিছু সময়ের জন্য রোমানদের দখলে চলে যায়। সেসময় এটি রোমান ক্যাথলিক ক্যাথেড্রাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় কিছুকাল। যতদিনে বাইজেন্টাইনরা পুনরায় এই স্থাপত্যের দখল ফিরে পায়, ততদিনে এটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। তাই বাইজেন্টাইন শাসকগণ আবারও মেরামত করে তাদের সাধের প্রার্থনালয়ের পুরনো সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনেন।


পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে অটোম্যান সম্রাট ফাতিহ্ সুলতান মেহমেদ কন্সট্যান্টিনোপল দখল করেন। অটোমানরা কন্সট্যান্টিনোপলের নতুন নাম দেয় ইস্তাম্বুল। সেসময় আবারও বিপর্যয়ের মুখে পড়ে বাইজেন্টাইনদের প্রধান প্রার্থনালয় হাজিয়া সোফিয়া।


ইস্তাম্বুলের উপর অটোমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে তারা হাজিয়া সোফিয়াকে মসজিদ হিসেবে রুপান্তরের চিন্তা করে। হাজিয়া সোফিয়ার ভেতরের অনেক খ্রিস্টীয় নিদর্শনকে তারা বদলে ফেলে। এ স্থাপত্যের দেয়ালে এবং মেঝেতে যেসব খ্রিস্টীয় প্রতীক ছিলো, সেগুলোকে অটোমানরা ঢেকে ফেলে ইসলামিক লিপি দিয়ে। মসজিদের ঐতিহ্য অনুসারে একটি মিহরাব স্থাপন করা হয় হাজিয়া সোফিয়ার পশ্চিমের দেয়ালে। মিহরাবের দু’পাশে স্থাপন করা হয় দুটি ব্রোঞ্জের বাতি। 


এ স্থাপত্যকে ঘিরে চারদিকে নির্মাণ করা হয় চারটি মিনার, যেগুলো থেকে আযানের ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ত চারপাশে। সময়ের পরিক্রমায় এমন অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে হাজিয়া সোফিয়া ব্যবহৃত হতে থাকে মুসলিমদের প্রার্থনালয় মসজিদ হিসেবে।

বর্তমানের হাজিয়া সোফিয়া

অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের একশ বছরেরও বেশি সময় পরে আজও, রাজনীতি ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে হাজিয়া সোফিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ। কামাল আতাতুর্ক তুরস্ক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নয় বছর পরে, ১৯৩৫ সালে হাজিয়া সোফিয়াকে একটি জাদুঘরে রুপান্তর করা হয়। 


জাদুঘরে রুপান্তরের পরে বাইজেন্টাইন আমলের বিভিন্ন খ্রিস্টীয় প্রতীক ও ছবি পুনঃস্থাপন করা হয় হাজিয়া সোফিয়াতে। বর্তমানে খ্রিস্টান এবং মুসলিমদের ধর্মের নানা প্রতীক এবং বাণী পাশাপাশি দেখতে পাওয়া যায় হাজিয়া সোফিয়াতে। সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি ধর্মবিশ্বাসের আশ্চর্য এক সহাবস্থান চোখে পড়ে জাদুঘরটিতে।


hagia sophia

হাজিয়া সোফিয়ার অভ্যন্তরভাগের সাজসজ্জা; Image Source: Busy

প্রতিবছর তিন মিলিয়নেরও বেশি দর্শনার্থী তুরস্কের এই কালজয়ী স্থাপনাটি দেখতে ভীড় জমায় ইস্তাম্বুলে। আজও এ স্থাপনাকে ঘিরে রয়েছে নানা ধরনের রাজনীতি, বিভেদ এবং আলোচনা-সমালোচনা। তবু সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে, দিনশেষে এই অসাধারণ স্থাপত্যকীর্তির শৈল্পিক আবেদনই মূখ্য হয়ে ওঠে দর্শনার্থীদের কাছে।


আরও পড়ুন- অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলিম স্বাধীন সুলতান: শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ