Header Ads Widget

বি বি নিউজ
বাংলা খবর সবার আগে

বাদশাহ বাবরের কাবুলের সেই দিনগুলো

babur in kabul

BB NEWS DESK-

‘কাবুল চার ঋতুর দেশ (শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ও বসন্ত)। এখানকার ভূমি বেশ উর্বর। এখানে পূর্বে লামঘানত, পেশোয়ার, হশতনগর ও হিঁদুস্তানের (হিন্দুস্তান) কিছু অংশ আছে। পশ্চিমে পর্বতমালা রয়েছে। 

মির্জা বাবর তাঁর আত্মজীবনী ‘বাবরনামা’য় কাবুলের ভৌগোলিক বর্ণনা এভাবেই দিয়েছেন। বাবরের আত্মজীবনী ‘বাবরনামা’য় শুধু কাবুলের ভৌগোলিক বর্ণনাই আছে তা না, তিনি এই গ্রন্থে তৎকালীন সময়ের কাবুলের বিস্তারিত বিবরণ, কাবুলের জলবায়ু, চারণক্ষেত্র, পাহাড়-পর্বত, বসবাসকারীদের বর্ণনা, এমনকি কাবুলের পাখি, ফসলের পর্যন্ত বর্ণনা পর্যন্ত বিস্তারিত দিয়েছেন। বাবর তাঁর জীবনের ১০ বছরের বেশি সময় কাটিয়েছিলেন এই কাবুলে। আর তাই এসবের বিস্তারিত বর্ণনা লেখার জন্য প্রয়োজনীয় সময় তিনি পেয়েছিলেন।

হিন্দুকুশ পর্বতমালার অপরূপ সৌন্দর্য; Source: Youtube.com

কাবুলে এসে পৌছানোর জন্য বাবর হিন্দুকুশ পর্বতমালার দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এসেছিলেন। কাবুলের দখলদার সুলতান মুহাম্মদ মুকিমের সাথে সামান্য কিছু সংঘর্ষের পর ১৫০৪ সালের অক্টোবর মাসের বাবর কাবুল দখল করে নিতে সক্ষম হন। এসময় তাঁর বয়স হয়েছিলো মাত্র ২৩ বছর!


মির্জা বাবর হুসাইন মির্জার সাথে জোটবদ্ধ হয়ে উজবেকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে খোরাসানের উদ্দেশ্যে কাবুল ত্যাগ করেন। এই ঘটনা ১৫০৬ সালের জুন মাসের। কিন্তু পথে বাবরের জন্য দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছিলো। কাবুল ত্যাগের পরপরই বাবরের কাছে সুলতান হুসাইন মির্জার মৃত্যুসংবাদ এসে পৌছে। বাবর কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেলেন তিনি কী করবেন এটা নিয়ে। তিনি তাঁর আমিরদের সাথে পরামর্শ করলেন। বাবরের আমিররা তাকে কাবুলে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত বাবর খোরাসানের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিলেন।

উজবেক নেতা শায়বানী খান; Source: Wikimedia Commons

১৫০৬ সালের নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে বাবর খোরাসানের সীমানায় পৌঁছে গেলেন। বাবুরের খোরাসান পৌঁছানোর খবর পেয়ে সুলতান হুসাইন মির্জার দুই পুত্র বদিউজ্জামান ও মুহাম্মদ মুজাফফর বাবরকে সম্মান জানাতে ছুটে এলো।  হুসাইন মির্জার এই দুই পুত্র তাঁর মৃত্যুর পর যৌথভাবে তাঁর রাজ্যের উত্তরাধীকারী হন। বাবর তাদের সাথে কিছুদিন খোরাসান অবস্থান করলেন। তিনি মনে মনে তখনো তাদের সঙ্গে নিয়ে উজবেকদের সাথে যুদ্ধের ব্যপারটি ভাবছিলেন।


মৃত্যুর পূর্বে সুলতান হুসাইন মির্জা প্রায় ৮০ বছর খোরাসান শাসন করেছিলেন। তাঁর সুশাসনে খোরাসান বেশ সমৃদ্ধি অর্জন করেছিলো। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর খোরাসানের ভাগ্য দুর্ভাগ্যে পরিণত হলো। কারণ হুসাইন মির্জার কোনো পুত্রই তাঁর মতো যোগ্য ছিলো না। উজবেকরা যখন খোরাসানের সীমান্তে ক্রমাগত হুমকি-ধামকি দিয়ে যাচ্ছিলো, তখন সিংহাসনে বসার পর এই দুই ভাই সেনাবাহিনী গঠনে মনোযোগ দেয়ার চেয়ে বিলাসিতা আর মদ্যপানেই বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠে। শীঘ্রই রাজ্যে অশান্তির হাওয়া বইতে শুরু করলো। ফলে বাবর তাদের নিয়ে উজবেকদের সাথে যুদ্ধের পরিকল্পনা ত্যাগ করে কাবুল ফিরে যেতে মনস্থির করলেন।


 সম্রাট বাবরের কন্যা, মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের বোন গুলবদন বেগমের ‘হুমায়ুননামা’য় এই ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় এভাবে-

‘সুলতান হুসাইন মির্জা প্রায় ৮০ বছর শাসন করেছেন (খোরাসান)। এ দীর্ঘ শাসনকালে তিনি খোরাসানকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশে পরিণত করেন। কিন্তু তাঁর পুত্র মির্জাগণ বাবার যোগ্য উত্তসসূরী ছিলেন না। তাঁর মৃত্যুর পর তারা খোরাসানের শান্তি ৬ মাসও ধরে রাখতে পারেন নি। মির্জাদের রাজস্ব আদায়ে দুর্বলতা এবং বিলাসিতায় বিপুল অর্থের অপব্যয় আমার পিতা ভালো চোখে দেখেন নি। তাই তিনি খোরাসান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি পরাজিত রাজ্যগুলোর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার কথা বলে কাবুলে ফিরে আসার প্রস্তুতি নেন।’

মির্জা বাবর খোরাসান ত্যাগ করে কাবুলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। তাঁর বাহিনী গৌড়বন্দ নামক জায়গায় এলে হাজারা বিদ্রোহীরা বাবরের বাহিনীকে আক্রমণ করে। কিন্তু বাবুরের সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে টিকতে না পেরে হাজারারা পালিয়ে যায়। বাবর এখানে প্রচুর গণিমত অর্জন করেন।


বাবর যখন কাবুলের নিকটবর্তী মিনার পাহাড়ের কাছাকাছি এসে পৌছান, তখন তাঁর কাছে আরেকটি দুঃসংবাদ এসে পৌছায়। কাবুলে বাবরের অনুপস্থিতির সুযোগে বাবরেরই চাচাতো ভাই মির্জা মুহাম্মদ হুসাইন আর মির্জা খান বিদ্রোহ ঘোষণা করে কাবুলের দখল নিয়ে নিয়েছে। অগত্যা বাবর নিজেই নিজের রাজ্যই অবরোধ করলেন। ছোটখাট কয়েকটি সংঘর্ষের পর মির্জা মুহাম্মদ হুসাইন আর মির্জা খান হাল ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যান।


কাবুলের ‘বাগ-ই-বাবুর’। বাদশাহ বাবরের আদেশে ১৫২৮ সালে কাবুলে এই বাগানটি নির্মাণ করা হয়। মুঘলদের সবসময়ই বাগানের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিলো। মুঘলরা যেখানেই সীমানা বিস্তার করতে পেরেছিলেন, এখানেই তৈরি করেছেন বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর বাগান; Source: beautifulglobal.com

বাবর মাত্র ২৩ বছর বয়সে কাবুল দখল করেন। তাঁর এই ২৩ বছরের জীবনে অর্জন কিন্তু খুব কম ছিলো না। সাড়ে এগারো বছর বয়সে ফারগানার শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। ১৪৯৭ সাল আর ১৫০০ সালে সম্পূর্ণ নিজের শক্তির জোরে দুই দুইবার তৈমুরের স্বপ্নের নগরী সমরকন্দ বিজয় করেছিলেন। অবশ্য একবারও সমরকন্দ নিজের দখলে রাখতে পারেন নি। ফারগানা আর সমরকন্দ- দুটি শহরই হাতছাড়া হয়ে গেলে তিনি বেশ কিছুদিন পথে পথে ঘুরেছিলেন। অবশেষে ১৫০৪ সালে কাবুল বিজয় করে কিছুটা স্থির হওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু তাতেও অবশ্য বাবরের মনে খুব একটা শান্তি ছিলো না।


কারণ তখনো তাঁর কোনো জীবিত সন্তান ছিলো না, যে বাবরের পর তাঁর রাজ্যের হাল ধরবে। ‘হুমায়ুননামা’র বর্ণনাতে বাবুরের ১৭ বছর বয়সী একজন কন্যা সন্তানের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু জন্মের মাত্র একমাস পরেই বাবরের কন্যাসন্তানটি মারা যায়। ‘বাবরনামা’র বর্ণনাতে এই কন্যার নাম ফখরুন নিসা উল্লেখ করা হয়েছে। এই কন্যার মায়ের নাম ছিলো আয়েশা সুলতানা। তিনি খোরাসানের সুলতান হুসাইন মির্জার কন্যা ছিলেন।


বাগ-ই-বাবুরের আরেকটি অসাধারণ দৃশ্য; Source: beautifulglobal.com

মোট কথা, কাবুল অধিকার করে মোটামুটি সুখী সমৃদ্ধিশালী জীবন যাপন করলেও বারের মনে কোনো শান্তি ছিলো না। একটি সন্তানের জন্য তিনি সবসময়য় অস্থির বোধ করতেন। আল্লাহ তাঁর এই অস্থিরতা দূর করেছিলেন। হিজরি ৯১৩ সালের ৪ জিলকদ তারিখে কাবুলের দুর্গে সম্রাট বাবরের এক পুত্রসন্তান জমগ্রহণ করেন। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দিনটি ছিলো ১৫০৮ সালের ৬ মার্চ। ‘হুমায়ুননামা’র বর্ণনাতে বাবুরের এই পুত্রের জন্মের রাতটিকে বিশেষায়িত করে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে-

‘সেই বিশেষ রাতের সূচনায় গোধূলি লগ্নে আকাশে সূর্য একটি স্বর্গীয় আভা ছড়িয়ে দিয়েছিলো। ’

বাবর তাঁর এই পুত্রের নাম রাখলেন হুমায়ুন। পুরো নাম রাখা হলো নাসরুদ্দীন মুহাম্মদ হুমায়ুন। তবে শৈশবে হুমায়ুনকে ‘সুলতান হুমায়ুন খান’ আর ‘শাহ-ই-ফিরুজ কাদির’ নামে ডাকা হতো।


 পুত্র হুমায়ুনের জন্মে মির্জা বাবুর এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে, দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে তিনি একটি পরিকল্পনা করলেন। তিনি হুমায়ুনের জন্মের দিন থেকে নিজের জন্য নতুন উপাধি ‘পাদশাহ’ ব্যবহার করার ঘোষণা দিলেন। ‘হুমায়ুননামা’য় এই ঘটনার বর্ণনা এসে এভাবে-

‘এই বছরেই (১৫০৮ সাল) আমার মহান পিতা আমির ওমরাহদের আদেশ দেন যে এখন থেকে তাঁর উপাধি হবে পাদশাহ। এভাবেই পৃথিবী তাকে জানবে এখন থেকে। হুমায়ুনের জন্মের পূর্ব পর্যন্ত বাবুর পরিচিত ছিলেন বাবুর মির্জা নামে। শাসকদের সন্তানরাও মির্জা নামে পরিচিত ছিলেন তখন। এভাবেই আমার পিতা হুমায়ুনের জন্ম তারিখটাকে স্মৃতিময় করে রাখলেন পাদশাহ উপাধি গ্রহণের মাধ্যমে।’ 

উল্লেখ্য, ‘পাদশাহ’ একটি ফার্সি শব্দ। এর তুর্কি সমার্থক শব্দটি হচ্ছে ‘পাদিশাহ’। হিন্দুস্তানে এই শব্দটির সমার্থক শব্দটি হচ্ছে ‘বাদশাহ’।


হুমায়ুনের জন্মের সমসাময়িক সময়েই বাদশাহ বাবর আরেকটি সুসংবাদ পেলেন। বাবরের চিরশত্রু উজবেক নেতা শায়বানী খান পারস্যের শাহ ইসমাইলের সাথে ১৫১০ সালে একটি যুদ্ধে পরাজিত হন। পরে তাকে হত্যা করা হয়। এই শায়বানী খানের কারণেই বাদশাহ বাবুর দুইবার সমরকন্দ থেকে বিতাড়িত হন। এমনকি নিজের জন্মভূমি ফারগানা থেকেও তাকে পালিয়ে আসতে হয়েছিলো। তাই শায়বানী খানের মৃত্যু সংবাদে যে বাবর খুবই খুশি হয়েছিলেন, একথা নিঃসন্দেহে বলে দেয়া যায়! তবে একই সাথে বাবর কিছুটা হতাশ হয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিলো তিনি নিজে শায়বানী খানকে পরাজিত করে হত্যা করবেন। কিন্তু তাঁর সেই ইচ্ছা আর পূরণ হলো না।


শায়বানী খানের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর বাদশাহ বাবর আবারো সমরকন্দের দিকে নিজের বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যান। তাঁর ইচ্ছা তৈমুরের সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করা। পারস্যের শাহ ইসমাইলের সহযোগীতায় ১৫১১ সালে তিনি আবারো সমরকন্দ দখল করে নেন। একই সালে তিনি বুখারা জয় করে নেন। এসময় তাঁর সাথে তাঁর পুত্র হুমায়ুন মির্জা ছিলেন। তবে সমরকন্দের ক্ষেত্রে বাবরের ভাগ্য সত্যিকার অর্থেই ভালো ছিলো না। পারস্যের শিয়াদের সহায়তা নেয়ায় সমরকন্দের সুন্নি মুসলিমরা বাবরকে এবার আর ভালো চোখে দেখে নি।


 তারা সত্যিকার অর্থেই এই কারণে বাবরকে ঘৃণা করতে শুরু করে। ফলে সমরকন্দে আবারো রাজনৈতিক অস্থিশীলতা তৈরি হয়। জনগণের সহায়তা না পাওয়ায় বাবুর উবায়দুল্লাহর কাছে যুদ্ধে পরাজিত হন। তিনি এবার বেশ ভালো বুঝতে পারেন সমরকন্দ চিরজীবনের জন্য তাঁর হাতছাড়া হয়ে গেছে। সমরকন্দের মানুষেরা আজীবনের জন্য তাকে ঘৃণা করে যাবে!


১৫০৯ সালের কাবুলের দুর্গে বাবরের আরেকটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। বাদশাহ বাবুরের দ্বিতীয় এই পুত্রের নাম রাখা হয় কামরান। কামরানের মায়ের নাম গুলরুখ বেগম। কামরানের জন্মের ১০ বছর পর, ১৫১৯ সালের শুরুর দিকে বাদশাহ বাবর বাজুর আক্রমণ করেন। মাত্র ২/৩ ঘন্টার যুদ্ধে তিনি বাজুর দখল করে নিতে সক্ষম হন। বাজুরে অবস্থানকালে তিনি তাঁর আরেকটি পুত্র সন্তান জন্মের খবর পান। দিলদার বেগমের গর্ভে জন্ম নেয়া এই সন্তানের নাম রাখা হয় হিন্দাল। হিন্দাল শব্দটির মানে ‘হিন্দুস্তান বিজেতা’। বাবুর কেন তাঁর পুত্রের এই নাম রাখলেন, সেই আলোচনা আরেকদিন করা যাবে!


কান্দাহারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য; Source: flickr.com

এখানে তিনি তাঁর গুপ্তচরদের নিকট থেকে একটি পত্র পান। পত্রে বাবরকে বাদাখশানের শাসক মির্জা খানের মৃত্যুসংবাদ জানানো হয়েছিলো। এই পত্রটি পেয়ে বাবর গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। কারণ সেই সময় বাদাখশানের সীমান্তের কাছাকাছি একটি শক্তিশালী উজবেক বাহিনী অবস্থান করছিলো। আর মির্জা খানের পুত্র শাহজাদা মির্জা সুলায়মান নিতান্তই নাবালক। তাঁর পক্ষে এখনই উজবেকদের মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে বাদাখশান উজবেকদের হাতে চলে যাবে।


বাদশাহ বাবর দ্রুত এই সংকট সমাধানের চেষ্টা চালালেন। শেষপর্যন্ত শাহজাদা মির্জা সুলায়মানের মাতা এবং বাদাখশানবাসীদের সম্মতিতেই তিনি বাদাখশানের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। তবে তিনি মির্জা সুলায়মানকে নিজের পিতৃ অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন নি। পারিবারিক সূত্রে পাওয়া সমস্ত সম্পত্তি মির্জা সুলায়মানকে দিয়ে দেয়া হয়। সেই সাথে রাজকীয় মর্যাদা আর প্রয়োজনীয় ভূখন্ডের জায়গীর তাকে দেয়া হয়েছিলো। আর বাদাখশানের শাসনভার অর্পণ করা হয়েছিলো মির্জা হুমায়ুনের কাছে। মির্জা হুমায়ুনকে বাদাখশানের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে স্বয়ং বাদশাহ বাবর নিজে সেখানে যান। বাদাখশানের দায়িত্ব নেয়ার সময় মির্জা হুমায়ুনের বয়স হয়েছিলো ১৩ বছর।


 মাত্র ১৩ বছরের এক কিশোর এই বয়সে বাবা-মাকে ছেড়ে এত দূরে একা একা কী না কী করবে এই ভেবেই হয়তো বাদশাহ বাবুর নিজেই বাদাখশানে গিয়েছিলেন। তবে মির্জা হুমায়ুনের মতোই কাছাকছি বয়সে বাবুর উত্তরাধিকার সূত্রে ফারগানা অর্জন করেছিলেন। আবার সেই বয়সেই নিজ যোগ্যতায় সমরকন্দের মতো শক্তিশালী আর ঐতিহ্যবাহী একটি শহর দখল করে নিয়েছিলেন। ‘হুমায়ুননামা’য় হুমায়ুনের বাদাখশানের দায়িত্বগ্রহণের ব্যাপারটি উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে-

‘শাসনভার গ্রহণের জন্য মির্জা হুমায়ুন বাদাখশানের দিকে রওয়ানা দিলেন। এরপর হুমায়ুনের পথ অনুসরণ করে বাদশাহ বাবুর ও আমার বিমাতা (এখানে মাহাম বেগমের কথা বলা হয়েছে) বাদাখশানের দিকে যান। বেশ কয়েকদিন তাঁরা সেখানে অবস্থান করেছিলেন। বাদাখশানের দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে হুমায়ুনের হাতে তুলে দেয়ার পর বাদশাহ ও বেগম, অর্থাৎ, আমার বাবা ও মা কাবুলে ফিরে আসেন।’

 

বাদাখশানের মির্জা হুমায়ুনের ক্ষমতাপ্রাপ্তির কিছুদিন পরেই বাদশাহ বাবর শাহ বেগ আরঘুনের দখলে থাকা কান্দাহার আর কালাত অবরোধ করেন। কালাত খুব সহজেই বাবরের পদানত হয়। কিন্তু কান্দাহারকে প্রায় দেড় বছর অবরোধ করে রাখতে হয়েছিলো। কিন্তু শেষপর্যন্ত কান্দাহার বাবরের সামনে মাথানত করতে বাধ্য হয়। কান্দাহারের শাসনভার অর্পণ করা হয় মির্জা কামরানের কাছে। কান্দাহারের কাজ শেষ করে বাদশাহ বাবর কাবুলে ফিরে আসেন।


বাদশাহ বাবর প্রায় দশ বছরেরও বেশি সময় বেশ শান্তিতেই কাবুল শাসন করেন। এসময় তাঁকে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক বা সামরিক জটিলতায় পড়তে হয় নি। কাবুলে তিনি বেশ সুখী-সমৃদ্ধশালী একটি জীবন লাভ করেছিলেন। প্রথমদিকে একটি সন্তানের জন্য তাঁর ভেতরে যে অস্থিরতা ছিলো, পরবর্তীতেও তাও- কেটে যায়। কাবুলেই তিনি একে একে আঠারোজন সন্তানের জনক হন। ‘হুমায়ুননামা’র বর্ণনায়-

‘আল্লাহর রহমতে কাবুল বিজয়ের পর আমার পিতার প্রাসাদ সন্তান সন্ততিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এখানেই তাঁর আঠারটি সন্তানের জনক হন। তবে এক স্ত্রীর গর্ভেই তাঁর সকল সন্তানের জন্ম হয় নি। স্ত্রী মাহাম বেগমের গর্ভে জন্ম নেন মুঘল সিংহাসনের উত্তরাধীকারী হুমায়ুন, বারবুল মির্জা, মেহেরজান বেগম, ইশান দৌলত বেগম এবং ফারুক মির্জা। অপর স্ত্রী মাসুমা বেগমের কোল জুড়ে আসে এক কন্যা শিশু। কিন্তু শিশুটি জন্ম দিয়েই মাসুমা বেগম ইন্তেকাল করেন। তাঁর স্মরণে এ কন্যার নাম রাখা হয় মাসুমা বেগম।

স্ত্রী গুলরুখ বেগমের কোল জুড়ে যে সন্তানরা আসে তাদের নাম কামরান মির্জা, আসকারি মির্জা, শাহরুখ মির্জা, সুলতান আহমেদ মির্জা এবং গুল ইজার বেগম। দিলদার বেগমের গর্ভে জন্ম নেন গুলরঙ বেগম, গুল চিহরা বেগম, হিন্দাল মির্জা, আমি (‘হুমায়ুননামা’র লেখিকা) গুলবদন বেগম এবং আলওয়ার মির্জা।’

‘বাবরনামা’ আর ‘হুমায়ুননামা’র বর্ণনাতে বাদশাহ বাবুরে মোট নয়জন স্ত্রীর কথা উল্লেখ করা আছে। আর ‘হুমায়ুননামা’তে বাদশাহ বাবুরের মোট ১৯ জন সন্তানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বাদশাহ বাবুরের পুত্র হুমায়ুনের শাসনকালে বাবুরের মাত্র ৪ পুত্র (বাদশাহ হুমায়ুনসহ) এবং ৪ কন্যা জীবিত ছিলেন।


তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, কাবুলে বাদশাহ বাবুর একটি নিশ্চিন্ত সুখী জীবনযাপন করছিলেন। তাঁর কাছে তখন বিশাল একটি রাজ্য ছিলো, রাজ্যে সুখ-সমৃদ্ধি ছিলো, কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতাও ছিলো না। সব মানুষই হয়তো এমন জীবন পেতে চাইবে। কিন্তু যার নামই হচ্ছে বাবুর, যার অর্থ বাঘ, যিনি ছোটবেলা থেকেই বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন, তিনি কী নিশ্চিন্ত আর সুখের জীবন যাপনে সন্তুষ্ট হতে পারেন?

তথ্যসূত্র

১। বাবরনামা- জহির উদ দিন মুহাম্মদ বাবুর (অনুবাদ: মুহাম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস)

২। হুমায়ুননামা- মূল গুলবদন বেগম (অনুবাদ: এ কে এম শাহনাওয়াজ)

৩। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়- সাহাদত হোসেন খান


আরও পড়ুন- আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পারস্যের জাতীয় বীর- বাবাক খোরামদিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ