BB NEWS DESK-
সভ্যতার উত্থানের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে জাদুবিদ্যা। গুহাবাসী মানুষ যখন শহর-নগর এবং সুসংঘটিত সভ্যতার পত্তন ঘটানো থেকে বহুক্রোশ দূরে, তখন থেকেই জাদুবিদ্যার প্রচলন। সমাজ পরিচালনা, ঐতিহ্যগত এবং ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় জাদুবিদ্যা ছিল অন্যতম দৈনন্দিন এবং গুরুত্বপূর্ণ এক অনুষঙ্গ।
তথ্যসূত্র
মেসোপটেমীয় সভ্যতার স্রষ্টা হিসেবে খ্যাত সুমেরীয় সভ্যতাতেই প্রথম লিখন পদ্ধতির উদ্ভব ঘটেছিল। তারা বিভিন্ন জিনিস মৃত্তিকা ফলকে লিপিবদ্ধ করে রাখত।
কিউনিফর্ম নথি থেকে জানা যায়, তারা জাদুবিদ্যায় কীরকম মন্ত্র জপ করত, জাদুবিদ্যায় তাদের প্রায়োগিক দক্ষতা, ব্যবহৃত ভেষজ ঔষধপত্র, প্রাকৃতিক জগতের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য কী পদ্ধতি ব্যবহার করত তারা। অ্যাসিরীয় সম্রাটদের আমলে বহু জাদুবিদ্যা ও মন্ত্রের সামাজিক ও ধর্মসম্মত বৈধতা ছিল। এসব মন্ত্রকে পঙক্তি ও ক্রম আকারে সাজানো হয়েছিল একটি পুস্তকে, যাকে বলা হয় ‘হ্যান্ডবুক’।
মাকলু
মেসোপটেমীয় ডাকিনীবিদ্যার চর্চা
মেসোপটেমীয় ডাকিনীবিদ্যার অন্তর্গত মাকলুতে ডাকিনীর নাম গোপন থাকে। বেনামী এক ডাকিনীকে উদ্দেশ্য করে মন্ত্র জপ করা হতো। কারণ, তাদের বিশ্বাস দেবতারা সব দেখেন, এবং কে জাদুবিদ্যার এই অপপ্রয়োগের সাথে জড়িত, তা দেব-দেবীরা ভালো করেই জানেন। তাই, এখানে ডাকিনীর ঠিকানা জানাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
এক্ষেত্রে একজন তান্ত্রিক ঝাড়ফুঁকের আয়োজন করতেন। মাকলু বাকিসব মেসোপটেমীয় পাণ্ডুলিপির মতোই মেসোটেমীয় সভ্যতার অজানা দিকগুলো রহস্যজট খুলতে সাহায্য করে। মাকলুর বর্ণনা অনুসারে, জাদুবিদ্যার আচার-অনুষ্ঠান দু’ভাবে পালিত হতো। যেসব জাদু চর্চার বৈধতা ছিল সমাজে, তা সকলের সামনেই করা হতো, কিন্তু অবৈধ কিংবা কালোজাদুর চর্চা করা হতো গোপনে, সকলের অগোচরে।
অশুভ জাদুবিদ্যার মাধ্যমে ডাকিনীরা মূলত দেবতাদের ফাঁকি দিয়ে থাকত। তারা দেবতাদের বোঝাতে চাইত, জাদু দিয়ে তারা লোকজনকে অনিষ্টের হাত থেকে রক্ষা করতে চাইছে। কিন্তু বিশ্বাসের বাস্তব চিত্র ছিল উল্টো। কারও ক্ষতির উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হতো এই কালোজাদু। অপরদিকে, মাকলুর আচার-অনুষ্ঠানে পালন করার উদ্দেশ্য ছিল দেবতাদের বোঝানো যে, তারা ভুল মানুষকে তাদের ঐশ্বরিক শক্তি দিয়ে সাহায্য করেছেন।
পূর্বাভাস
আক্কাদীয় ভাষায় কিউনিফর্ম লিপিতে হাজার বছর ধরে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার বিভিন্ন সভ্যতার কাহিনি মৃত্তিকা ফলকে লিপিবদ্ধ হয়েছে। ধারণা করা হয়, টিকে থাকা প্রায় ৩০% আক্কাদীয় কিউনিফর্ম পাণ্ডুলিপি ডাকিনীবিদ্যা এবং অতিপ্রাকৃত বিষয় সম্পর্কিত। তবে এর অধিকাংশ জিনিসই যে জাদুবিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়টা এমনও নয়। কিছু জিনিস এখনও রহস্যাবৃত, কিছু জিনিস তাদের সামাজিক রীতির সাথে সম্পৃক্ত।
মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রকৌশল শাখার আঁতুড়ঘর হলেও, মহাকাশের কার্যকলাপ এবং অপ্রত্যাশিত প্রাকৃতিক অনেক ঘটনা সম্পর্কে তাদের পরিষ্কার ধারণা ছিল না। ভবিষ্যতে ঘটতে পারে এমন নেতিবাচক ঘটনা এড়ানোর জন্য তারা বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণী করত। পাণ্ডুলিপি থেকে জানা যায়, দুর্যোগ এড়ানোর জন্য মেসোপটেমীয়বাসী পূর্বাভাসের তালিকা তৈরি করে রাখত।
দুর্বোধ্যতায় আচ্ছন্ন এনুমা আনু এনলিল নামক এক পাঠ থেকে রাজা ও রাজ্য সম্পর্কিত ৭০০০ স্বর্গীয় পূর্বাভাসের বর্ণনা পাওয়া যায়। রাজামশাইয়ের নিজস্ব পণ্ডিত এই পূর্বাভাস থেকে রাজাকে প্রতিনিয়ত হালনাগাদ পাঠাতেন। আরেক পূর্বাভাস হলো ‘সুমা আলু ইনা মেলে সাকিন’, যেটাতে ১২০টি মৃত্তিকা ফলকে এবং প্রায় ১০ হাজারের কাছাকাছি পূর্বাভাস বর্ণিত রয়েছে। এই পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এটাই সবচেয়ে বৃহৎ পূর্বাভাসের সমাহার।
সুমা ইবজু পূর্বাভাস তালিকা অঙ্গহীন মানবজন্ম এবং বিদঘুটে প্রাণীজন্মের সাথে সম্পৃক্ত। তবে এই পূর্বাভাস যে সবসময় অকল্যাণের সাথে জড়িত, ব্যাপারটা এমন নয়। যেমন, মানব শরীরের অঙ্গবিকৃতি শরীরের ডানদিকে হলে সেটা সেটা অশুভ এবং বাঁ দিকে হলে সেটাকে কল্যাণময় হিসেবে ভাবা হতো।
পেশাদার জাদুকর
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় জাদুবিদ্যা চর্চাকে অনেকে পেশা হিসেবেও বেছে নিয়েছিল। পেশাদার এই জাদুকরেরা জাদুবিদ্যার যেকোনো এক শাখায় তুখোড় পারদর্শী হতো। কারও অগাধ জ্ঞান ছিল ঝাড়ফুঁকে, আবার কেউ হতো ভবিষ্যদ্বাণীতে দক্ষ। আশিপু নামে পরিচিত দক্ষ জাদুকরেরা সকল জনগণকেই সাহায্য করত মৃত্যু এবং সমাধি সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠানে।
আশিপু অনেকসময় অ্যাসিরীয় সম্রাটদের পরামর্শদাতা হিসেবেও নিযুক্ত থাকতেন। দৈবজ্ঞরা (বারু) দেবতা থেকে প্রাপ্ত পূর্বাভাস এবং ভবিষ্যদ্বাণীকে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। বারুরা সাধারণত অ্যাসিরীয় সম্রাটদের রাজদরবারের পণ্ডিত বা সেনাবাহিনীর অনুচর হিসেবে নিযুক্ত থাকতেন। অন্য সকল সভ্যতার মতো মেসোপটোমিয়াতেও সমাজের সকল পেশার মানুষ একসাথে বসবাস করত। তাই, এসব তান্ত্রিক ও জাদুকরদের পাশাপাশি সমাজে বিজ্ঞানী, শিক্ষক, চিকিৎসক, জ্যোতির্বিদদেরও অস্তিত্ব ছিল।'
দৈনন্দিন জীবনে জাদুবিদ্যা
মেসোপটেমীয়বাসীর দৈনন্দিন জীবনে যে জাদু ছিল ডাল-ভাতের মতোই সাধারণ জিনিস, তার প্রমাণ মিলেছে এক পাণ্ডুলিপি থেকে। ওখানে বিভিন্ন প্রকার পাথরের বিস্তারিত বর্ণনা ও নির্দেশনা দেওয়া আছে, যাতে কেউ সহজেই বুঝতে পারে কোনো দেবতাকে আকর্ষণ করা বা তাড়ানোর জন্য কোন পাথর ব্যবহার করতে হবে।
দেবতা, প্রাণী ও রহস্যময় বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি মেসোপটেমিয়ার (আশুর, নিনেভা, ব্যাবিলন, নিমরুদ) বিভিন্ন ঘরের মধ্যে রাখা হতো বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এগুলো রাখা হতো ঘরের গোপন কোনো জায়গায়, যেখানে প্রেতাত্মা বা পিশাচেরা জমায়েত হতে পারে। তাদের বিশ্বাস এই মূর্তিগুলো তাদের অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা করবে।
মেসোপটেমীয়দের বিশ্বাস ছিল, দেবতা পাজুজু মানবজাতির জন্য দুর্ভিক্ষ এবং খরা নিয়ে আসতেন। দক্ষিণ-পশ্চিমের বায়ুও তার নির্দেশে প্রবাহিত হতো বলে তাদের ধারণা ছিল। কারণ, মেসোপটেমিয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমের বায়ু সবসময় অতিরিক্ত গরম এবং শুষ্কতা নিয়ে আসত বলে বায়ু পরিবর্তনের কারণে তখনকার লোকেরা অসুস্থ হয়ে পড়ত। রোগ-শোক এবং দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচতে অনেকসময় মেসোপটেমীয়রা তার পূজা-অর্চনা সম্পন্ন করেছে। বহু পণ্ডিতের মতে, পাজুজু নিরাময় এবং চিকিৎসাব্যবস্থার সাথেও যুক্ত থাকতে পারেন।
অতিপ্রাকৃত জিনিসের সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন বস্তু ব্যবহারের রীতি ছিল তখন। এদের আকার-আয়তন ক্ষেত্রবিশেষে ছিল ভিন্ন। তা ক্ষুদ্র তাবিজ-কবচ থেকে শুরু করে বিশাল বড় মূর্তিও হতো।
জ্ঞান-বিজ্ঞানে সামসময়িক অন্যান্য সভ্যতা থেকে এগিয়ে থাকলেও জাদুবিদ্যার প্রতি ছিল মেসোপটেমীয়দের অগাধ বিশ্বাস। প্রাচীনকালের আনুষ্ঠানিক ঝাড়ফুঁক ‘মাকলু’কে আজকে অনেকের কাছে উপহাসের পাত্র মনে হতে পারে, কিন্তু আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে অনুন্নত চিকিৎসাব্যবস্থার পৃথিবীতে এগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির মনে দু’দণ্ড শান্তি এনে দিত।
আরও পড়ুন- নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বংশধরের করুণ কাহিনী
0 মন্তব্যসমূহ